‘ফজরের নামাজের পর আসি লাইনত দাঁড়াই। ছয় ঘণ্টা পর চাউল পাই। যেদিন চাউল কিনবার আসি সেদিন কাজত যাবার পাই না। কামাই না করলে চাউল কিনি কি দিয়া। দুই দিন কামাই করি একদিন আসি লাইনত দাঁড়ায়া চাউল কিনি।’
সরকারের খোলা বাজারে চাল বিক্রি (ওএমএস) কার্যক্রমে চাল কিনতে এসে লাইনে দাঁড়িয়ে এভাবে কথাগুলো বলেছেন দিনমজুর আলম (৫২)। বৃহস্পতিবার (১৭ নভেম্বর) সকালে কুড়িগ্রাম জেলা শহরের খেজুরের তল এলাকায় ওএমএস ডিলারের দোকানে কথা হয় আলমের সঙ্গে।
আলমের বাড়ি সদর উপজেরার কাঁঠালবাড়ী ইউনিয়নের জোতগোবরধন গ্রামে। তিনিসহ শতাধিক নারী-পুরুষ ভোরবেলা থেকে লাইনে দাঁড়িয়েছেন স্বল্পমূল্যে চাল কেনার জন্য।
তাদের ভাষ্য, বাজারে উচ্চমূল্যে তারা চাল কিনতে পারছেন না। তাই লাইনে কষ্ট করে দাঁড়িয়ে চাল কেনার অপেক্ষা করছেন। কিন্তু দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার কারণে তাদের কারও দৈনিক উপার্জন আবার কারও সাংসারিক কাজ বিঘ্নিত হচ্ছে। তাদের জিজ্ঞাসা, উপার্জন না করলে চাল কিনবেন কি দিয়ে?
‘ফজরে আসি লাইন ধরি। এমনও দিন যায় দুপুরার আজান (জোহর) দিলে বাড়ি যাই। অভাবের সংসার, চাউল কিনতে দিন যায়। সংসারের কাজও করবার পাই না। বাজারত ৬০ টাকা চাউল। কিনবার পাই না জন্যে লাইনত আসি দাঁড়াই।’ লাইনে দাঁড়ানোর বিড়ম্বনার কথা বলছিলেন বেলগাছা ইউনিয়ন থেকে আসা গৃহবধূ জ্যোৎস্না বেগম।
এভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে চাল কেনার চেয়ে রেশন কার্ড দিয়ে চাল নেওয়া সুবিধাজনক বলে জানান পৌর এলাকার নাজিরা সরকার পাড়ার গৃহবধূ শাহিদা। শাহিদা বলেন, ‘এমন করি লাইনত দাঁড়া লাগে। রেশন কার্ড করি দিলে আমাদের সুবিধা হইলো হয়। এতো ভোরবেলা আসা লাগলো না হয়।’

একই গ্রামের গৃহবধূ আফরোজা বলেন, ‘কার্ড দিয়া যখন চাউল দিছে তখন সুবিধা ছিল। যখন তখন আসি চাউল নিবার পাইছি। এলা লাইনত দাঁড়াইলে সংসারের কাজও করবার পাই না। মানুষটা (স্বামী) না খায়া কাজত যায়। শিশুরা স্কুল যাওয়ার সময় কী খাইল তাও দেখপার পাই না।’
দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকায় কর্মঘণ্টার ক্ষতি হচ্ছে বলে জানান দর্জির কাজ করা আবু বক্কর সিদ্দিক (৬৫), আব্দুস সামাদসহ (৬৪) অনেকে। আবু বক্কর বলেন, ‘বাজারত চাইলের দাম বেশি হয়া হইছে সমস্যা। না হইলে আমরা আইসতাম না।’
চাল নিতে বরাদ্দের চেয়ে অনেক বেশি মানুষের চাপের কথা জানান ডিলার আতাউর রহমান প্রিন্স। তিনি বলেন, ‘আমাদের বরাদ্দ এক টন চাল ও এক টন আটা। যা জনপ্রতি পাঁচ কেজি করে ৪০০ ব্যক্তির কাছে বিক্রি করা হয়। কিন্তু প্রতিদিন প্রায় ৭০০-৮০০ মানুষ লাইনে দাঁড়ান। অনেকে এলাকার বাইরে থেকেও আসেন। বেশিরভাগ মানুষ চাল-আটা না পেয়ে ফিরে যান। আমরা তো বরাদ্দের বেশি দিতে পারি না।’
জেলা খাদ্য বিভাগ জানায়, জেলার প্রতিটি উপজেলায় ওএমএস কার্যক্রম চলছে। এর মাধ্যমে প্রতিদিন সদর উপজেলায় ৯ টনসহ জেলায় ২৮ টন চাল ন্যায্যমূল্যে (৩০ টাকা কেজি) বিক্রি করা হচ্ছে। তবে আটা বিক্রি হয় শুধু সদর উপজেলায়। এছাড়া ইউনিয়ন পর্যায়ে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির মাধ্যমে এক লাখ ৪৪ হাজার ১৪৮ জন সুবিধাভোগীকে প্রতি কেজি ১৫ টাকা হারে মাসে ৩০ কেজি চাল দেওয়া হচ্ছে।
ওএমএস কার্যক্রমে চাল বিক্রিতে ক্রেতাদের চাপ ও লাইনে দাঁড়িয়ে বিড়ম্বনার বিষয়টি স্বীকার করেছেন জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক (ভারপ্রাপ্ত) মো. আবু বকর। তবে এ বিষয়ে তার দফতরের কিছুই করার নেই বলে জানান তিনি।
খাদ্য নিয়ন্ত্রক আবু বকর বলেন, ‘প্রতিটি পয়েন্টে মানুষের চাপ রয়েছে। এখন হয়তো বরাদ্দ বাড়ালে ভালো হতো। কিন্তু এ পর্যায়ে আমাদের কিছুই করা নেই। এটা সরকারের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের বিষয়।’
‘আগে পয়েন্ট প্রতি দুই টন চাল বরাদ্দ ছিল। গত মাস থেকে এটা কমিয়ে এক টন করা হয়েছে। সরকার যদি মনে করে পরবর্তীতে আবার বাড়াবে তখন বাড়াতে পারে’ যোগ করেন আবু বকর।
