মেহেদীর রঙ হাত থেকে মিলেয়ে না যেতেই বিয়ের ২০ দিনের মাথায় মেলে তালাক। স্বামীর বাড়ি থেকে ফিরে আসার ২১ দিনের মাথায় বাবার বাড়িতে সেই স্বামী কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হন ভুক্তভোগী নারী। মামলা (মামলা নং-১০৮/২০১০) হলে ডাক্তারি পরীক্ষায় ধর্ষণের প্রমাণও মেলে। ওই ধর্ষণের ফলে গর্ভবতী হয়ে একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেন ভুক্তভোগী। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সংঘটিত এই ধর্ষণের ঘটনায় নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইবুনালে মামলা হলে দীর্ঘ এগারো বছরে মিললো বিচার, জন্ম নেওয়া সেই কন্যা সন্তান পেলো পিতৃ পরিচয় ও স্বীকৃতি।
রবিবার ( ১৪ ফেব্রুয়ারি) বিকালে কুড়িগ্রামজেলা নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইবুনালের বিচারক অভিযুক্ত খয়বর আলীকে (খয়ের আলী) যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও ছয় মাসের সশ্রম কারাদন্ডের আদেশ দেন। পাশাপাশি ধর্ষণের ফলে জন্ম নেওয়া কন্যা সন্তানের স্বীকৃতি ও বিবাহ না হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রকে তার ( কন্যা সন্তানের) ভরণ পোষণের দায়িত্ব নেওয়ার অদেশ দিয়েছেন আদালত।
ট্রাইবুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুর রাজ্জাক এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
আসামি খয়বর আলী, ভুক্তভোগী নারী ও তার সন্তানের উপস্থিতিতে আদালত এই রায় দেন। রায়ে আসামিকে জেল হাজতে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত।
আদালত সূত্রে জানা যায়, ২০১০ সালে আসামি খয়ের আলীর বিরুদ্ধে ভুক্তভোগী নারীর করা মামলায় ধর্ষণের যে অভিযোগ আনা হয়েছে মেডিকেল রিপোর্টে তার সত্যতা মিলেছে। এছাড়াও ভুক্তভোগী নারী, তার গর্ভে জন্ম নেওয়া সন্তান ও অভিযুক্ত খয়ের আলীর ডিএনও টেস্টের রিপোর্টেও প্রমাণ মিলেছে যে ওই নারীর গর্ভে জন্ম নেওয়া কন্যা সন্তানের বায়োলজিক্যাল বাবা খয়ের আলী। সাক্ষ্য প্রমাণে খয়ের আলীর বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্দেহাতীত ভবে প্রমাণিত হওয়ায় আদালত খয়ের আলীকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডের আদেশ দেন। একই সাতে জন্ম নেওয়া কন্যা সন্তানের স্বীকৃতি আদেশ ও রাষ্ট্রকে তার ভরণ পোষণের দায়িত্ব নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
ভুক্তভোগী নারীর সাথে কথা বলে জানা যায়, কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ঘোগাদহ ইউনিয়নের কাচিচর এলাকায় বাবার বাড়িতে জন্ম নেওয়া কন্যা সন্তানসহ বসবাস করেন ভুক্তভোগী ওই নারী।
বিচার চেয়ে আদালতের বারান্দায় দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন তিনি। দশ বছর বয়সি মেয়েকে নিয়ে সারাক্ষণ নিরাপত্তাহীনতায় দিনানিপাত করেন তিনি। মামলার পর থেকেই অভিযুক্ত খয়ের আলী ভুক্তভোগীর বাবাসহ তাকে নানাভাবে হয়রানী করলেও কোনও প্রতিকার পাচ্ছিলেন না। আসামি খয়ের আলী একই এলাকার বাসিন্দা হওয়ায় জন্ম নেওয়া সন্তানকে গুম করার ভয় দেখানোসহ তাকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে আসছিলেন। অবশেষে দীর্ঘ ১১ বছর পর তিনি প্রশান্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন।
ভুক্তভোগী ওই নারী বলেন, ‘ রায়ে আমি সন্তুষ্ট। আমি ন্যায় বিচার পেয়েছি। আমার জীবনে আরও কোনও চাওয়া পাওয়া নেই। এখন শুধু আমার মেয়েটার ভবিষ্যতের দিকে চেয় বেঁচে থাকার আশা।’
তিনি আরও বলেন, ‘ আমাকে তালাক দেওয়ার পর আমার বাবার বাড়িতে গিয়ে আমাকে ধর্ষণ করে খয়ের আলী। সেই ধর্ষণের বিচার চেয়ে আদালতে মামলা করি। পরে বুঝতে পারি ধর্ষণে আমি গর্ভবতী হয়ে পড়েছি। বিষয়টি পরবর্তীতে আদালতের নজরে আনলে আদালত বিষয়টি আমলে নেন এবং সন্তান জন্ম নেওয়ার পর আদালতের নির্দেশে আমার, আমার সন্তান ও অভিযুক্ত খয়ের আলীর ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়। ডিএনএ পরীক্ষায় প্রমাণ মেলে যে আমার গর্ভে জন্ম নেওয়া সন্তান খয়েরের ধর্ষণের ফল। কিন্তু তারপরও খয়ের আলী আমার সন্তানের স্বীকৃতি দিচ্ছিল না। এগারোটি বছর আদালতের বারান্দায় ঘুরতে ঘুরতে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি কিন্তু থেমে যায়নি, ধৈর্য হারাইনি। আজ আমি ন্যায় বিচার পেয়েছি। আমার সন্তানও তার স্বীকৃতি পেয়েছে। আমি আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাই। আদালতের বিচারকসহ সংশ্লিষ্ট আইনজীবীদেরও কৃতজ্ঞতা জানাই।’
ওই নারী আরও বলেন, ‘ ঘটনার পর থেকেই খয়ের আলী ও তার পরিবারের লোকজন আমাকে নানা ভাবে হয়রনী করে আসছে। তারা সবসময় আমার ও আমার মেয়ের ক্ষতি করার চেষ্টাসহ সমাজে আমাদের হেয় করে আসছে। তার সাজা হলেও তার পরিবার আমার ও আমার মেয়ের অনিষ্ট করতে পারে। এজন্য আমি নিরাপত্তা চাই। আমি যেন আমার মেয়েকে নিয়ে বাকি জীবন শান্তিতে থাকতে পারি।’
জানতে চাইলে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘রায়ে রাষ্ট্র পক্ষ সন্তুষ্ট। রায়ে ভুক্তভোগী নারী ও তার সন্তান ন্যায় বিচার পেয়েছে।’
এ মামলায় ভুক্তভোগী নারীর পক্ষে পিপি আব্দুর রাজ্জাকসহ আইনী লড়াই করেন সাবেক সিনিয়র জুডিশিয়াল মেজিস্ট্রেট ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু। আদালতে মামলার আর্গুমেন্টসহ গুরুত্বপূর্ণ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন এই আইনজীবী।
রায়ের প্রতিক্রিয়ায় অ্যাডভোকেট আজিজুর রহমান দুলু বলেন, ‘ এটি একটি চাঞ্চল্যকর মামলা। ঘটনার দীর্ঘ দশ বছর পর আমি এই মামলা সম্পর্কে জানতে পেরে সেচ্ছায় সংশ্লিষ্ট পিপির সাথে যোগাযোগ করে কোনও ধরণের পারিশ্রমিক ছাড়া বাদীর পক্ষে মামলাটি পরিচালনা করি। আজ মামলার রায়ে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাদীর পাশাপাশি আমিও অত্যন্ত খুশি। এই রায়ের মাধ্যমে সমাজে একটি ন্যায় বিচারের বার্তা পৌঁছে যাবে যার মাধ্যমে অনেক অপরাধী শিক্ষা গ্রহণ করবে।’
Leave a Reply