‘আমি এই ব্যবসায় শুরু করি ১৯৯৬ সাল থেকে। আমার প্রথম দোকান ছিল মিষ্টি মুখে। আমি দীর্ঘ দিনের চেষ্টায় এই এক টাকার সিঙারাটি বানিয়েছি। আমার ইচ্ছা দিনাজপুরবাসীর কাছে আমি একটি প্রশ্ন বোধক হয়ে থাকতে চাই। যাতে করে আমি মারাগেলে এই রাস্তা দিয়ে মানুষগেলে একটিবার চিন্তা করে যে, এইখানে একটাকার সিঙারা পাওয়া যেত। কিন্তু আজ আর নেই। মানুষ যাতে এই এক টাকার সিঙারা দিয়ে নিজের মনে ধরে রাখে।’ কথাগুলো জীবদ্দোশায় বলেছিলেন দিনাজপুরের নাম করা এক টাকার সিঙারার কারিগরি শচীন ঘোষ। অবশেষে ৭২ বছর বয়েসে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরলোক গমন করেছেন (ইন্তেকাল করেছেন)।
গত মঙ্গলবার (৫ এপ্রিল) রাত ১০ টায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি পৌর শহরের চকবাজার এলাকার মৃত মনিন্দ্রনাথ ঘোষ (মানু)’র বড় ছেলে ছিলেন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, দুই কন্যা, দুই ভাই এবং পাঁচ বোন রেখে গেছেন। তার মৃত্যু দুই বছর আগে তার একমাত্র ছেলে মৃত্যু বরণ করেছিলেন। তার মৃত্যুতে গভীর ভাবে শোক প্রকাশ করেছেন জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিমসহ সমগ্রদিনাজপুরবাসী।

পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, তিনি প্রথম দিনাজপুরবাসীকে এক টাকার সিঙারা উপহার দিয়েছিলেন। যে এক টাকার সিঙারার মুখরোচক স্বাদ গত ২৬ বছর ধরে মাতিয়ে রেখেছিল গোটা দিনাজপুরকে। তার শরীরের হাড়ের ফাটল ধরার কারনে তিনি ঢাকায় চিকিৎসাধীন ছিলেন। অবশেষে সেই ফাটলের স্থানটি ক্যানসার রোগে রূপান্তরিত হয়েছিল। চিকিৎসা শেষে গতকাল মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৮ টায় পরিবারে স্বজনরা তাকে নিজ বাড়িতে আনেন। পরে রাত ১০ টায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
শচীন ঘোষের বড় বোন সাবিত্রী ঘোষের ছেলে সমর কুমার ঘোষ বলেন, আমার মামা মৃত্যুর আগে বলেছিল, আমি দিনাজপুর যাবই। আর ঢাকায় থাকতে মন চাইছে না। গিয়ে আবার এক টাকার সিঙারা বিক্রি করা আরম্ভ করব। আমার দোকনটি একবারেই অপরিষ্কার হয়ে আছে। আমি একটাকার সিঙারা না খাওয়ালে দিনাজপুরবাসী আমাকে মনে রাখবে কি করে? আমি চলে গেলে আর কে খাওয়াবে এক টাকার সিঙারা। আমার সিঙারার স্বাদটাই আলাদা।

তার মৃত্যুতে গভীরভাবে শোক প্রকাশ করেছেন দিনাজপুর প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি চিত্ত ঘোষ। তিনি বলেন, শচীন ঘোষ ছিলেন দিনাজপুরবাসীর কাছে এমন একটি মানুষ। যাকে তার এক টাকার সিঙারা মহান করে রাখবে সমগ্র দিনাজপুরবাসীকে। তার মৃত্যু আমরা সকলেই শোকাহত। এমন একজন গুনি মানুষ চলে গেলেন। আমার পক্ষে মেনে নেওয়া খুবই কষ্টকর। মানতেই পারছি না তিনি আর নেই।
দিনাজপুর প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সুব্রত মজুমদার ডলার শোক প্রকাশ করে বলেন, মানুষটা একটাকার সিঙারাই শুধু ভালো ছিল না। তিনি মানুষ হিসেবেই অনেক ভালো ছিলেন। তার সিঙারা খেলে মনে হতো তিনি যেন মনের মাধুরি মিশিয়ে এই জিনিসটি তৈরী করেছেন। এমন একটা মানুষ চলে গেলেন। এটার মেনে নেওয়া সত্যি কষ্টসাধ্য হয়ে দাড়িয়েছে।
বাসুনিয়া পট্টি দূর্গা মন্দির কমিটির সভাপতি ডা. সান্তনু বসু বলেন, এমন গুনি মানুষ চলে যাওয়া আমার পক্ষে মেনে নেওয়া বড্ড কঠিন। তিনি চেয়েছিলেন এক টাকার সিঙারা দিয়ে মানুষের মাঝে যায়গা করে নিতে। আমার মনে হয় তিনি তা পেরেছেন। তার একটাকার সিঙারাই তাকে অনন্ত কাল মানুষের মনে জীবিত রাখবে।
পৌর শহরের বাসিন্দা মহাদেব রায় বলেন, কাকুর কাছে একটাকার সিঙারা কিনতে যেতাম। যেমন তার সিঙারা স্বাদ। তেমনই মিষ্টি তার ব্যবহার। তবে কেন জানি তর সইত না। ওখানে গেলে জিভে জল আসত। উনি বলতেন এক টাকার সিঙারা দিয়ে তিনি দিনাজপুরে নাম করবেন। আমার মনে হয় তিনি তা পেরেছেন। গতকাল মৃত্যুর খবর সব দিনাজপুরবাসী প্রচার করেছেন। একটা মানুষের প্রতি ভালোবাসা না থাকলে এই কাজটি সম্ভব নয়। তিনি স্বর্গবাসী হোক এই প্রার্থণা করব।
